হজের সফরে সার্বিক সুস্থতা প্রসঙ্গ

Hojer Sofore Sarbik Susthots Prosonggo

হজের সফরে সার্বিক সুস্থতা প্রসঙ্গঃ-

হজ পরম করুণাময় আল্লাহর অন্যতম ফরজ ইবাদত। বান্দার প্রতি স্রষ্টার হক। ঈমানের আলোকিত হ নিদর্শন। কুরআন মাজিদের ইরশাদ, মানুষের উপর আল্লাহর বিধান ওই ঘরের হজ করা, যার আছে সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য। আর কেউ কুফর করলে আল্লাহ তো বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন।’ – সূরা আলে ইমরান : ৯৭

এখন হজের মওসুম। মিম্বরে মিম্বরে হজের আলোচনা। কারও মুখে তালবিয়া, কারও মনে আগামীর স্বপ্ন, আর কারও হৃদয়জুড়ে মক্কা-মদিনার স্মৃতি ও পূণ্যভূমিতে সফরের অদম্য বাসনা। এভাবেই হজের মওসুম আসে আর গোটা মুসলিম জাহানের হৃদয় ও আত্মাকে আলোড়িত করে। যতদিন থাকবে মু’মিনের দেহে একবিন্দু প্রাণ, থাকবে উম্মাহর হৃদয়ে কিছুমাত্র ঈমানের স্পন্দন- ততদিন মক্কা, মদিনা, মিনা, আরাফা ও মুজদালিফা মু’মিন মুসলমানকে আলোড়িত করবেই।

হজ পালন করার উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে অসংখ্য মানুষ জমায়েত হয় কাবা শরীফের চারপাশে। এ হজব্রত পালন করার জন্য প্রতিটি মুসলমান উদগ্রীব থাকে এবং সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা চরম আবেগ ও ব্যাকুলতা নিয়ে মক্কায় আগমন করে। উদ্দেশ্য, করুণাময় মহান প্রতিপালকের দান ও ইহসানে ধন্য হওয়া, পুরস্কার ও প্রতিদানে কৃতার্থ হওয়া।

হজের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগেই হজের প্রতি ঐকান্তিক হওয়া এবং সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা। প্রতিটি হজ যাত্রীর জন্য অত্যাবশ্যক। সার্বিক প্রস্তুতির একটি অংশ হচ্ছে- মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং এ কথা মাথায় রাখা যে, সফল ও সুন্দরভাবে হজ পালন করা একটি শ্রমনির্ভর ও কষ্টসাধ্য বিষয়।

ওমরার তাওয়াফ, সাঈ, মিনা, মুজদালিফায় অবস্থান ও জামরায় পথর নিক্ষেপ, মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে হজের তাওয়াফ, সাঈ ইত্যাদি কার্য সম্পাদন করতে প্রচুর হাঁটাচলা করতে হয়। চাইলে যখন-তখন যানবাহন পাওয়া যায় না। হজের জন্য নির্ধারিত নতুন নতুন কাজ আঞ্জাম দিতে হয়। তাই হজের যাবতীয় অনুষ্ঠান ও আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি থাকতে হবে এবং সুস্থ-সবল শরীরে গন্তব্যে রওনা হতে হবে।

হজের সফর ও হজ চলাকালীন কিভাবে সুস্থ-সবল থাকা যায় এসব বিষয়ে বহুল প্রচারিত হেলথ ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য দেশবরেণ্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রফেসর ইমেরিটাস ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ প্রদত্ত “হজ পালনে শারীরিক সমস্যা ও করণীয়” শীর্ষক লেখাটি হাজীদের জন্য প্রকাশ করা হলো। আশা করা যায়, হাজীরা এতে উপকৃত হবেন।

শারীরিকভাবে বেশি ফিট থাকলে হজ পালনে কম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বেন। কোনো শারীরিক সমস্যা বোধ করলে কাছাকাছি মেডিকেল ক্যাম্পে গিয়ে সেবা নিতে হবে।

ইসলাম ধর্মে মুসলমানদের মধ্যে আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্যবানদের হজ পালন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ২০ থেকে ৩০ লাখ মানুষ হজব্রত পালন করতে সৌদি আরব যান। এ সময় হাজীদের স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এত বিপুল সংখ্যক মানুষের ভিড় হজ্বব্রত পালনের জন্য শারীরিক পরিশ্রম এবং সৌদি আরবের পরিবেশগত ভিন্নতার কারণে হাজীগণ নানারকম স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকেন।

হাজীদের স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেশের হজক্যাম্পে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। একইভাবে সৌদি সরকারও হজ যাত্রীদের স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়ে আগাম দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন।

সৌদি আরবে তাপমাত্রা বেশি ও মাথা উন্মুক্ত থাকার কারণে পুরুষের মধ্যে গরমজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি কিছুটা বেশি। এছাড়া হজ যাত্রীদের মধ্যে সংক্রামক রোগের ঝুঁকির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মেনিনগো-কক্কাল মেনিনজাইটিস বা মেনিনগো-কক্কাস নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত ইনফেকশনের বিষয়টিকে বেশ সতর্কতার সাথে দেখা উচিত।

এছাড়া অন্যান্য ইনফেকশনের মধ্যে শেভ বা ক্ষৌরকর্ম করার সময় এইচআইভি, হেপাটাইটিস-বি এবং সি’র ঝুঁকিও রয়েছে। এছাড়া সাধারণ সর্দিজ্বর, পেটের অসুখ, আমাশয় প্রায়ই দেখা যায়। সবচেয়ে জটিল হতে পারে মার্স ভাইরাসের আক্রমণ।

Hojer Sofore Sarbik Susthots Prosonggo

হজ পালনে শারীরিক সমস্যা ও করণীয় সতর্কতাঃ-

শুরু থেকেই এ জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

  1. হজের সময় রোদ এড়াতে কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে রাখা যেতে পারে। দরকার হলে মাথায় সাদা ছাতা ব্যবহার করতে হবে।
  2. গরমজনিত ঝুঁকি এড়াতে প্রচুর পানি পান করতে হবে। রাতে ভ্রমণ করতে হবে। ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়া লবনের ঘাটতি মেটানোর জন্য কিছুটা লবণাক্ত খাবার এ সময় দরকার হয়। শরীরের পানিস্বল্পতা এড়াতে সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি রাখতে হবে। অতিরিক্ত ঘামের কারণে সৃষ্ট শারীরিক অবসাদ কাটাতে খাবার স্যালাইন গ্রহণ করা যেতে পারে। এই খাবার স্যালাইন ডায়রিয়া হলেও উপকারে আসে। কাজেই সঙ্গে নিতে পারেন খাবার স্যালাইনও।
  3. বেশির ভাগ হজ যাত্রীই গলা ব্যথা, কাশি, ঘন ঘন হাঁচি, সর্দি এবং জ্বরে ভুগে থাকেন। হঠাৎ পরিবেশ পরিবর্তনের জন্য এমনটি হয়ে থাকে। এসব সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সাধারণ কিছু ওষুধপথ্য যেমন, ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল, হাঁচি, সর্দির জন্য ফেক্সোফেনাডিন-জাতীয় ওষুধ, কাশির জন্য কফ সিরাপ কিংবা ট্যাবলেট গ্রহণ করা যেতে পারে। এগুলো অল্প কিছু সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়াই ভালো।
  4. এছাড়া হজ পালনের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পর থেকে মাল্টিভিটামিন গ্রহণ করা উচিত। কারণ হজের দিনগুলোতে সুষম খাবারের অভাব দেখা দিতে পারে। সেই ঘাটতি পূরণে প্রতিদিনই মাল্টিভিটামিন গ্রহণ করা উচিত।
  5. অ্যাজমা বা হাঁপানি থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে পালনের প্রস্তুতি নিতে হবে। ইনহেলার বা নেবুলাইজার এবং অন্যান্য ওষুধপত্র সাথে রাখতে হবে।
  6. মসজিদে বা অন্য কোথাও চলাফেরার সময় কড়া সুগন্ধি ব্যবহার করা উচিত হবে না। কারণ সুগন্ধি হাঁপানি বা বিশেষ ধরনের মাথাব্যথা মাইগ্রেনের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।
  7. হজব্রত পালনের সময় হজযাত্রীদের অনেক হাঁটতে হয়। কাজেই দেশে থাকতেই হাঁটার প্রস্তুতি নিতে হবে। হাঁটা খুব ভালো ব্যায়াম। হজের জন্য রওনা হওয়ার ছয় থেকে আট সপ্তাহ আগে থেকেই হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
  8. হজ পালনের সময় ভিড়ের মধ্যে একজন হজযাত্রী থেকে অন্যজনের দূরত্ব থাকে সামান্য। এতে করে যেকোনো সংক্রামক রোগ খুব সহজেই একজন থেকে অন্যজনে ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে। কাজেই ঝুঁকি এড়াতে হোটেল বা অবস্থানস্থল থেকে বের হওয়ার সময় মুখে মাস্ক বা মুখোশ পরা যেতে পারে।
  9. যারা চশমা ব্যবহার করেন, অতিরিক্ত একজোড়া চশমা তাদের সঙ্গে নেওয়া উচিত। আর এই চশমার লেন্স এবং ফ্রেম প্লাস্টিক-জাতীয় উপাদানে তৈরি হলে ভালো। কারণ তাতে চশমা সহজে ভাঙবে না।
  10. হজের সময় অনেকেরই মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত সমস্যা হতে পারে। তাই মেনিনজাইটিস ভ্যাকসিন নিতে হবে। এমনকি ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন নেওয়া উচিৎ। হজ যাত্রীদের হজক্যাম্পেই এ ধরনের ভ্যাকসিন বা টিকা দেওয়া হয়ে থাকে।
  11. হজে যাওয়ার কমপক্ষে দুই মাস আগে দাঁতের চেকআপ করানো উচিত। দাঁতে কোনো সমস্যা থাকলে সেগুলো সারিয়ে নিতে হবে। তা না হলে দাঁতের সামান্য সমস্যা হজব্রত পালনের সময় বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
  12. ডায়াবেটিস রোগীর পায়ের যত্ন নেওয়া খুবই জরুরী। পায়ে নরম অথচ টেকসই জুতা পরতে হবে। তা না হলে সামান্য আঘাতে পায়ে ডায়াবেটিসজনিত বড় ক্ষত তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া অন্য ব্যক্তিদেরও পায়ের যত্ন হিসেবে নখ কাটা উচিত।
  13. যারা আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে ভোগেন যেমন, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা অন্যান্য ক্রনিক রোগ, তারা প্রয়োজনীয় ঔষধ নিতে ভুলবেন না। ডায়াবেটিস রোগীরা সুগার মাপার মেশিন সাথে রাখতে পারেন। মাঝে মাঝে সুগার মেপে সে অনুযায়ী ঔষধ খেতে হবে।
  14. হজ পালনের জন্য মহিলারা ঔষধ বা পিলের মাধ্যমে মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ রেখে হজের কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারবেন। তবে পিল খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরী।
  15. শারীরিকভাবে বেশি ফিট থাকলে হজ পালনে কম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বেন। কোনো শারীরিক সমস্যা বোধ করলে কাছাকাছি মেডিকেল ক্যাম্পে গিয়ে সেবা নিতে হবে।

Hojer Sofore Sarbik Susthots Prosonggo

ভালো লাগলে কিন্তু ফেসবুক পেজ এ লাইক দিতে ভুলে জাবেন না।
আরো তথ্য পেতে ভিজিট করুন.